মীর ফরহাদ হোসেন সুমন,লক্ষ্মীপুর :
মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর মাটির কারণে এ অঞ্চলে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়। দেশে উৎপাদিত ৮০ ভাগ সয়াবিন লক্ষ্মীপুর থেকেই জোগান দেওয়া হয়। যে কারণে এ জেলা সয়াবিনের রাজধানী হিসেবে খ্যাত।
স্থানীয় কৃষকদের কাছে সয়াবিন শস্যটি ‘সোনা’ হিসাবে পরিচিত। এখন রবি মৌসুম। এ সময়ে সয়াবিন আবাদ হয়। তাইতো সোনা ফলাতে বিস্তির্ণ মাঠজুড়ে বীজ বুনেছে কৃষকরা।
জেলার রামগতি রায়পুর কমলনগর রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় আমন ধান কাটার পরই কৃষকরা সয়াবিন আবাদের প্রস্তুতি নেন। জমিতে রস থাকতে থাকতে চাষ দেন। আইল কেটে নেন, জমির উঁচু-নিচু সমান করেন। আগাচা পরিষ্কার, জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। জমি শুকালে মই দিয়ে মাটি ঝরঝরে করা হয়। সব প্রস্তুতি শেষে বীজ বুনেন কৃষকরা।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চলতি মৌসুমে সয়াবিনের বীজ বুনা শেষ হয়েছে।
কৃষকরা সারিতে এবং ছিটিয়েও সয়াবিনের আবাদ করেছেন। বীজ থেকে চারা উঠতে শুরু হয়েছে। সামনে পরিচর্যার পালা। আগাছা মুক্ত রাখা, প্রয়োজনে সেচের ব্যবস্থা করা। পোকা-মাকড় দমনে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়া। এসব যথাযথ হলে সোনা ফলে। হয় বাম্পার ফলন।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, সয়াবিন চাষে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয়। চাষাবাদ পদ্ধতি সহজ। সয়াবিনে ধানের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। বিক্রি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হয়। যে কারণে কৃষকরা সয়াবিন চাষে আগ্রহী।
জমির মালিক ও বর্গাচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চরাঞ্চলে অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অনাবাদি জমি পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পড়ে থাকা ওইসব জমিতেও সয়াবিন চাষে সাফল্য আসছে।
হাজিরহাট ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রফিক উল্লাহ মুরাদ বলেন, সয়াবিন বছরের সব সময় চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে ফলন বেশি হয়। যে কারণে রবি মৌসুমে সয়াবিনের আবাদ হয়ে থাকে। ৯৫ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.৫ টন উৎপাদন হয়ে থাকে।
কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ফারুক ভূঁইয়া বলেন, সয়াবিনের পাতাসহ অন্যান্য অংশ এবং শিকড় অল্প সময়ের মধ্যে পচে-গলে মাটিতে জৈব সার তৈরি করে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অনেক উন্নত হয়। মাটি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সয়াবিন চাষের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পরবর্তী ফসলে সারের ব্যবহার অর্ধেক নেমে আসে। উৎপাদন খরচ কমে যায়। ফলনও ভালো হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি লক্ষ্মীপুর অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলার ৫ উপজেলায় ৪৮ হাজার ৫১৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৭ হাজার ৮৫ হেক্টর, রায়পুরে ৬ হাজার ২১০ হেক্টর, রামগঞ্জে ৭২ হেক্টর, রামগতিতে ১৭ হাজার ২৫০ হেক্টর ও কমলনগরে ১৭ হাজার ৯০০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৩০১ মেট্রিক টন।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, আবাহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়। ভালো ফলন পেতে কৃষি অফিস ও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নোয়াখালী অঞ্চলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাণিজ্যিকভাবে সয়াবিন চাষে আমদানি নির্ভরতা কমানো, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, দারিদ্রদূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব।
সয়াবিন তেল জাতীয় শস্য। গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গাছের কাধে ফুল হয়। ফুল থেকে শিমের মত চড়াতে বীজ জন্মে, এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। সয়াবিন ভোজ্য তেলের প্রধান উৎস। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। কচি ও শুকনো সয়াবিন বীজ সবজি ও ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। পরিণত সয়াবিন বীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই ও পনির, বিস্কুট ও কেকসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার তৈরি হয়ে থাকে। এছাড়াও পোল্ট্রি ও ফিসফিড তৈরি, রং, সাবান এবং প্লাস্টিক মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান।