খুলনা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয়াকে কেন্দ্র করে বুধবার দুপুরে ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ’র বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। ক্ষুব্ধ এই অংশ উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নে অর্থ বাণিজ্য করাসহ নানাবিধ অভিযোগ এনেছে। এ সময় বক্তারা দাবি করেন, ‘প্রতিমন্ত্রী ভোট দিয়ে দিবেন, যাকে জেতাবেন তাকেই দেবেন’, এই ফর্মুলায় ডুমুরিয়ার তার নিজ বাসভবনে দলীয় কাউন্সিলরদের ডাকেন এবং তাদের সামনে সমর্থকদের নাম মৌখিকভাবে বলতে বলেন। এভাবেই নামে মাত্র মতামত নিয়ে কাউন্সিলরদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নিজের পছন্দমত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। ইউপি নির্বাচনের গনতন্ত্র এখন প্রতিমন্ত্রীর পকেটে। তারা খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন করে যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানান।
সূত্রানুযায়ী, খুলনায় ৬৭টি ইউনিয়নে মনোনয়ন দেয়ার জন্য জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং যে ইউনিয়নে নির্বাচন হবে সেই ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সমন্বয়ে নির্বাচনী বোর্ড গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশ করা পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী বোর্ড কর্তৃক তা অনুমোদন করবে।
তবে প্রথম দফায় খুলনার তিন উপজেলার রূপসা-তেরখাদা ও দিঘলিয়ার ১৪টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে উঠেছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির অনুসারী গ্রুপটি দাবি করেছে যে, মনোনয়ন দেবার ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম করা হয়েছে। অযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না মেনেই করা হয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অগঠনতান্ত্রিকভাবে অনেক ওয়ার্ড কমিটি ও কয়েকটি ইউনিয়ন কমিটিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী গ্রুপটি ৬৭টি ইউনিয়নের জন্য একশত জন প্রার্থীর তালিকা গত সপ্তাহে পাঠিয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার কাছে দেয়া হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়ায় এখনো কোন মনোনয়ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তার বাইরে কোন কাজ হবে না।
মঙ্গলবার খুলনায় দাকোপের ৯ ইউনিয়ন, ডুমুরিয়ার ৭ ও দিঘলিয়ার সেনহাটী ইউনিয়নে প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে দিনভর দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মনোনয়ন বঞ্চিতরা অভিযোগ করছেন প্রার্থী বাছাইয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের বাদ রেখে বিতর্কিতদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। পছন্দের ব্যক্তিকে মনোনীত করতে ৭ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের মৌখিক সমর্থন আদায়ে অনৈতিকভাবে প্ররোচনা চালান প্রতিমন্ত্রী। দাকোপের ৯ ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের উপজেলা সভাপতি আলহাজ্ব শেখ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের সাথে আলোচনা ছাড়াই তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলীয় প্রার্থী করেছেন।
লিখিত বক্তব্যে দাকোপের তিলডাংগা ইউনিয়নে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী গাজী সেলিম হোসেন বলেন, ভূয়া ভোট প্রদানসহ জালিয়াতির মাধ্যমে সভা দেখিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের দ্বারা উপজেলার সভাপতি প্যানেল তৈরি করেছেন। যার মধ্যে নারী ধর্ষণকারী, রাজাকার পরিবারের সদ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও বহিস্কৃতরা রয়েছে। মূলতঃ আবুল হোসেন অর্থের বিনিময়ে তথাকথিত প্যানেল সৃষ্টি করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, নিজের মনোনীত ব্যক্তি প্রার্থী করতে আবুল হোসেন তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন সভাপতিকে বাদ রেখে ৩নং সহ-সভাপতিকে দিয়ে সভার সভাপতিত্ব করাচ্ছেন। লাউডোবে অবৈধ সন্তান জন্মদাতা পঞ্চানন মন্ডলকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
এদিকে ডুমুরিয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে দলের ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম, প্রতিমন্ত্রী ও উপজেলা সভাপতি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপির অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলাধীন ৭ ইউনিয়নের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আটলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. প্রতাপ কুমার রায়। সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয় কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে গত সোমবার প্রতিমন্ত্রী তার বাসভবনে ৭ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদককে ডেকে আনে। সেখানে তিনি তার পছন্দের ব্যক্তিকে মনোনীত করতে সকলের মৌখিক সমর্থনের আদায়ে অনৈতিকভাবে প্ররোচনা চালান। এরমধ্যে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, দলে অনুপ্রবেশকারী, সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামি, একাত্তরে শান্তি কমিটির সভাপতি পুত্রসহ অবৈধভাবে সুবিধাভোগীরা রয়েছে। ব্যক্তিগত সুবিধা প্রদানকারীদের প্রার্থী করতে মন্ত্রী মরিয়া হয়ে ইউনিয়ন নেতাদের মৌখিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টার কারণে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে বিতর্কিত প্রহসন নির্বাচন বাতিল ও সঠিক কমিটি গঠন প্রসঙ্গে দিঘলিয়া উপজেলাভুক্ত ৪নং সেনহাটী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ফারহানা নাজনীন খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তার মরহুম স্বামী গাজী আঃ হালিম ইউনিয়নের বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। চরম দুর্দিনে দলকে সংগঠিত রেখেছেন। তবে তার সমর্থন দেখে জেলা পর্যায়ে কতিপয় কূটকৌশলী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার মৃত্যুতে উপ-নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। তিনি জানান, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেনহাটী ইউনিয়নের ও চন্দনীমহল সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নামীয় কতিপয় বিতর্কিত ও বংশীয় পেশী শক্তি সম্পন্নরা গত শনিবার পেছনের তারিখ বসিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে। কমিটিতে দুর্দিনে দলের পাশে থাকা পরীক্ষিতদের নাম বাদ দেয়া হয়। এছাড়া চন্দনীমহল সাংগঠনিক ইউনিয়নের সভাপতি গাজী আজগর আলী, স্ত্রী, ভাগ্নে, বেয়াই, কাজের লোক ও বংশের রাজনৈতিকদের নাম জুড়ে ভুয়া কাউন্সিলর/কমিটি তৈরি করেন। তার মনোনীত প্রার্থীর কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে জেলা উর্ধ্বতন কতিপয় নেতার উপস্থিতিতে ভোটের ব্যবস্থা করে। কেন্দ্রের নির্দেশে কমিটিতে ৩ ভাগের ১ ভাগ মহিলা তালিকাভুক্ত করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। তিনি অভিযোগ তোলেন সাবেক বিএনপি নেতা ও ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শেখ ইখতিয়ার হোসেনকে চন্দনীমহল সাংগঠনিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। ৬নং ওয়ার্ডের বহি®কৃত সভাপতি, জামায়াত-বিএনপি’র অসংখ্য লোককে নিজেদের তথা আজগর আলী, ইখতিয়ার মেম্বর দলীয় কাউকে না জানিয়ে কাউন্সিল কমিটি গঠন করে। তিনি বিতর্কিত প্রহসন এ নির্বাচন বাতিল ও সঠিক কমিটি গঠনে উপজেলা, জেলা কেন্দ্র তথা দলের সভাপতি শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ দিন। দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী ৬৭ ইউনিয়নে মনোনয়ন জমা দেবেন বলে জানা গেছে।