মিথ্যা তথ্য প্রচারে জড়িত সম্পাদকদের বিচার হবে

0
339

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুটি পত্রিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের লিখে দেওয়া মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা মিথ্যা তথ্য প্রচারের ষড়যন্ত্রে জড়িত সম্পাদকদের বিচারের আওতায় আনা হবে। গতকাল সোমবার মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা জানান। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের তীব্র সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কই, তিনি ভুল স্বীকার করে পদত্যাগের সাহস তো দেখাতে পারলেন না। এতটুকু আত্মমর্যাদাবোধ থাকলে এর পর তিনি পদত্যাগ করতেন।’ সম্প্রতি একটি টেলিভিশন আলোচনায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এক প্রশ্নের মুখে বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা ‘খবর’ যাচাই না করে ছাপানো ছিল তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের ‘বিরাট ভুল’। এরপর দেশব্যাপী তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নেতাকর্মীরা একের পর এক মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে চলেছে। গতকাল ডেইলি স্টারের পাশাপাশি তাদের সহযোগী দৈনিক প্রথম আলোরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘গোটা ২০টা বছর আমার রাজনৈতিক জীবনে এই পত্রিকাগুলো শুধু আমার বিরুদ্ধে কুৎসাই রটনা করে গেছে, আমার বিরুদ্ধে লিখে গেছে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের শত্রু।’ তাঁকে দুর্নীতিবাজ বানানোর চেষ্টায় ওই সম্পাদকরা উঠে পড়ে লেগেছিলেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দুটি পত্রিকা ডিজিএফআইয়ের লিখে দেওয়া মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে সে সময় রাজনীতি থেকে আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম আমাকে দুর্নীতিবাজ বানানোর জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। তিনি স্বীকারও করেছেন।’ মাহফুজ আনামকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে উনার কী সখ্য ছিল? উনাকে যা ধরিয়ে দিতেন তাই হুবহু ছাপিয়ে দিতেন।…যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হচ্ছে, ঠিক সেভাবে একদিন তাঁদেরও বিচার হবে।’ তিনি বলেন, ‘সত্য কখনো চাপা থাকে না। মাহফুজ আনামকে একটা কথাই বলব, অনেক চেষ্টা করেছেন। আপনার পিতৃতুল্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও দুর্নীতিবাজ বানাতে পারেনি।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বিনা ওয়ারেন্টে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সলিটারি কনফাইনমেন্টে পাঠানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কারাগারে কোনো শাস্তিপ্রাপ্ত আসামিকেও এক সপ্তাহের বেশি সলিটারি কনফাইনমেন্টে  রাখতে পারে না, আর ১১টা মাস আমি ছিলাম সেখানে।’ শেখ হাসিনা বলেন, গ্রেপ্তারের সময় তাঁর অসুস্থ স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। কারাগারে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা করানো হয়নি। তিনি বলেন, সেখানে স্যাঁতসেঁতে ঘরে তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়, তাঁর গায়ে অ্যালার্জি উঠে যায়, চোখে সমস্যা দেখা দেয়। এরপর পরীক্ষা করে চিকিৎসক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিলেও তাঁকে কারাগারেই পাঠানো হয়। সেখানে ঈদের দিন কেবল স্বামী ও ফুফুকে দেখা করতে দিলেও তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছিল মিডিয়ার সামনে মুখ না খুলতে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু আমার ফুফুও বঙ্গবন্ধুর বোন, তিনি নিজের বাড়িতে সাংবাদিক ডেকে যখন কারাগারের ভেতরের পরিস্থিতি জানান, তখন আমার চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ১৬টা মামলা আমার বিরুদ্ধে তখন। বিএনপির দেওয়া প্রায় এক ডজন আর বাকিগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাঁরা মামলা দেওয়ার জন্য এত দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন—১১ মাস যদি আপনাদের সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়, আর যদি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, আর যদি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়, এবং আমার ছেলেমেয়ে আমার বোন তাদের ওপর পর্যন্ত যে অত্যাচার, মানসিক চাপ, তাদের পরিবারের প্রতি যদি এ রকম করা হয়, তাহলেও কি তাঁরা বিবৃতি দেবেন? সহানুভূতি দেখাবেন, যাঁরা আমাদেরকে ওই ধরনের বিপদে ঠেলে দিয়েছেন?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বিপদ শুধু আমার একার ছিল না, এই বিপদ ছিল সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের বিপদ। এঁদের ক্ষমতালিপ্সাই একটা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল। আজ তাঁদের হয়ে এত বিবৃতি, একটু মামলায়ই ঘাবড়ে গেলেন? আর জেলের সলিটারি কনফাইনমেন্টে যদি ১১ মাস রাখা হয়, তাহলে কী হতো?’ কিছুদিন আগে একটি ভুল খবর প্রকাশের কারণে বিবিসির সাংবাদিক, সম্পাদক ও মহাপরিচালকের পদত্যাগের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিবিসির মহাপরিচালক থেকে শুরু করে যাঁরা যাঁরা ওই সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে জড়িত তাঁদের সবাই পদত্যাগ করেছিলেন। তাঁদের সৎসাহস ছিল, পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু এই সম্পাদক সাহেব (মাহফুজ আনাম) জিডিএফআইয়ের লেখা ছাপিয়ে ভুল করেছেন বললেন, কিন্তু এই ভুলের খেসারত বাংলাদেশের জনগণ দিল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিল, এ দেশের ব্যবসায়ী মহল দিল, ছাত্রসমাজ দিল, সবাই দিল। আর যেহেতু আমার বিরুদ্ধে লিখেছে, সে জন্য আমি ও আমার পরিবার তো দিয়েছিই।’ সূত্র : বাসস, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ। ‘এরপর সাংবাদিকরা ভুল স্বীকার করতে চাইবেন না’ প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের জবাবে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় গতকাল মাহফুজ আনাম বলেছেন, তাঁকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই এসব বলা হচ্ছে। কারণ সেই সময় ওই খবরগুলো অনেক সংবাদমাধ্যমই প্রকাশ করেছিল। মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমি মনে করেছিলাম স্বতঃপ্রণোদিতভাবে জনসমক্ষে ভুল স্বীকার করে আমি  দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে যেন ভুল স্বীকার করাটাও আমার একটা ভুল হয়েছে। এর যে ফল হবে তা হলো সাংবাদিকরা নিজের ভুল স্বীকার করার কোনো রকম উৎসাহ আর পাবেন না।’ তিনি বলেন, ‘ওই খবরগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই না করে ছাপানোর ফলে আমি যথাযথ সম্পাদকীয় বিবেচনা বোধের পরিচয় দিতে পারিনি—আমার এই আত্ম-উপলব্ধিমূলক মন্তব্য থেকে সাংবাদিকতার একটা বিরাট দুর্বল জায়গা উন্মোচিত হয়েছে। আমরা যে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার চাপে থাকি, সেটা বেরিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে যেন পরিস্থিতি এদিকে না যায়, আলোচনাটা সেদিকে গেলে দেশের সাংবাদিকতার জন্য লাভ হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here