প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজের কমিশনিং অনুষ্ঠানে বলেছেন, চলতি বছরে নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করা হবে।
তিনি বলেন, ‘নৌবাহিনীতে সংযোজিত হতে যাচ্ছে বহু আকাক্সিক্ষত দুটি সাবমেরিন। এই অন্তর্র্ভুক্তির মাধ্যমে নৌবাহিনী এক ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে রূপান্তরিত হতে চলেছে।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে চট্টগ্রামের নৌবাহিনীর ঘাঁটি বিএনএস ঈশা খাঁন-এ অনুষ্ঠিত বানৌজা স্বাধীনতা, সমুদ্র অভিযান এবং বানৌজা প্রত্যয়-এর কমিশনিং অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘এরই ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জ শিপইয়ার্ডে নিজস্ব প্রযুক্তিতে সাবমেরিনের জন্য প্লাটফর্ম তৈরী হচ্ছে। এছাড়া আমাদের সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম ড্রাই ডকে যুদ্ধজাহাজ তৈরীর পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন,আমাদের সরকারের আমলে নৌবাহিনীতে মেরিটাইম হেলিকপ্টার এবং মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট সংযুক্ত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি দ্বি-মাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে আরও দুটি করভেট গণচীনে নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে একটি আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। জাতির পিতার মহান প্রত্যয়ের আলোকেই আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি আধুনিক ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের ধারাকে অব্যাহত রেখে আমরা নৌবাহিনীর জন্য ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রণয়ন করি। এর পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে নৌবাহিনীতে ১৮টি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ সংযোজন করেছি।
এই সংযোজিত যুদ্ধজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধপারদর্শিতা বৃদ্ধির জন্য অত্যাধুনিক ফ্রিগেট, করভেট ও প্যাট্রোল ভেসেল। হাইড্রোগ্রাফিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সার্ভে ভেসেল এবং লজিস্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ফ্লিট ট্যাংকার ও কন্টেইনার ভেসেল বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবস্থান আরও সুসংহত এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে নৌবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে আধুনিক ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর সদস্যদের অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান এবং দেশের জলসীমায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য এই বছর বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির জন্য মনোনীত হয়েছে। আমি নৌবাহিনীর সকল সদস্যকে এজন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে অমিত সম্ভবনার দেশ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বিশ্বের বুকে একটি শক্তিশালী ও গতিশীল অর্থনীতি হিসেবে জেগে উঠার সকল সহায়ক পরিবেশ ও ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।’
ক্রমাগত সম্পদ আহরণের ফলে বিশ্বের স্থলভাগের সম্পদ আজ সীমিত এবং সারা বিশ্বের নজর এখন সমুদ্র সম্পদের দিকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারও ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারের উদ্যোগে আজ বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের রয়েছে সুনির্দিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা। দেশের এই বিশাল সমুদ্র এলাকায় বাণিজ্য পরিচালনা ছাড়াও আছে মৎস্য, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ পদার্থসহ মূল্যবান সম্পদ।’
আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক জীবনে এই সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি ভৌগোলিক অবস্থান এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের এই জলসীমা ও তার সম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জাতিনজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
নৌবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন গৌরবজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাতির পিতার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারত হতে সংগৃহীত ‘পদ¥া’ ও ‘পলাশ’ নামে দুইটি পেট্রোল ক্রাফ্ট নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বানৌজা ঈসা খানকে প্রথম “নেভাল এনসাইন” প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, আজ তিনটি জাহাজ কমিশনিং-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আরও একধাপ এগিয়ে গেল। দিনটি শুধু বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির জন্যই অত্যন্ত গৌরবের। মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে আজ নৌবাহিনীতে সংযোজিত হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত যুদ্ধজাহাজ “বানৌজা সমুদ্র অভিযান” এবং চীনে নবনির্মিত “বানৌজা স্বাধীনতা” ও “বানৌজা প্রত্যয়”।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করার অগ্রযাত্রায় সহযোগিতার জন্য আমি আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং গণচীনকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিশাল সমুদ্র আপনাদের কর্মক্ষেত্র। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে উত্তাল সমুদ্রে দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্য নিষ্ঠার যে উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত আপনারা স্থাপন করেছেন, দেশবাসী তা শ্রদ্ধাভরে স¥রণ করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সাগরের মত আপনাদের আছে গভীর দেশপ্রেম। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্র সম্পদের বিরাট ভূমিকা কাজে লাগানোর গুরুদায়িত্ব আপনাদের উপর ন্যস্ত।’
এরআগে প্রধানমন্ত্রী জাহাজের কমান্ডিং অফিসারের নিকট জাহাজের কমিশনিং ফরমানন হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী সকালে নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খান-এ পৌঁছলে নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডিমিরাল মোহাম্মদ নিজুমুদ্দিন আহমেদ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল আকতার হাবিব তাঁকে স্বাগত জানান।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, উচ্চপর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কমৃকর্তাবৃন্দ এবং কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ফ্লাইপাস্ট এবং বিভিন্ন নৌজাহাজের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত মহড়াও প্রত্যক্ষ করেন।