ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে আজ কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে পুরো শহর উত্তাল হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি প্রায় শেষ মুহুর্তে ধরমশালা থেকে কলকাতায় সরিয়ে আনতে হয়েছে – কিন্তু বিশ্বকাপের এই বাড়তি পাওনাটাই যেন কলকাতাকে ওই ম্যাচের একটা টিকিটের জন্য পাগল করে তুলেছে।
ইডেনের কর্মকর্তারা টিকিটের দাবি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, ওদিকে স্টেডিয়াম-টিম হোটেল থেকে শুরু করে শহরের আনাচ-কানাচ ঘিরে দেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়।
ইডেন গার্ডেন্স থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে গঙ্গার ধারে কলকাতার বাবুঘাট। সেই ঘাটের ধারে, স্টেডিয়ামের আশেপাশে সর্বত্র ছোট ছোট জটলা – শনিবার সন্ধ্যার ম্যাচের একটা টিকিটের জন্য চরম আকুলিবিকুলি।
উড়ো গুজবের পেছনে বিস্তর ছোটাছুটি করে অনেকেই নিরাশ হচ্ছেন – কিন্তু যারা টিকিট পেয়েছেন আর যারা পাননি, সবাই বলছেন এই পাগলামি কলকাতাকেই মানায়।
‘দেখুন এটুকু তো হবেই। সত্তর হাজার আসনের স্টেডিয়াম, এমন কী লক্ষ লোক বসার ব্যবস্থা থাকলেও তাতেও দেখতেন সামাল দেওয়া যেত না – কলকাতায় ক্রিকেট এতটাই জনপ্রিয়’, বলছিলেন কোনওক্রমে টিকিট জোগাড় করতে পারা এক যুবক।
তবে মহামেডান স্পোটিং মাঠের কাউন্টার, যেখান থেকে সামান্য কিছু টিকিট বিলি করা হচ্ছিল, অনেককেই দেখা গেল টিকিট যেভাবে বিক্রি করা হয়েছে তার পদ্ধতি নিয়ে প্রবল ক্ষুব্ধ।

ইডেন গার্ডেন্সের মালিকানা যাদের, সেই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল বা সিএবি-র নতুন সচিব হয়েছেন অভিষেক ডালমিয়া – প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার ছেলে। এই বিরাট ম্যাচের আগের দিন তিনি অবশ্য বিবিসিকে বলছিলেন – ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই, দেখবেন ইডেন ঠিক আবার বাজিমাত করবে’।
অভিষেক ডালমিয়ার কথায়, ‘ইডেন তো আগে বিশ্বকাপের ফাইনালও আয়োজন করেছে। এমন তো নয় যে আগে আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ করিনি। ফলে এবারেও দেখবেন, দর্শকরা দারুণ একটা ম্যাচ উপহার পাবেন। ’
কলকাতার একটা বৈশিষ্ট্য হল – শোয়েব আখতার, ইমরান খান বা আসিফ ইকবালের মতো পাকিস্তানি ক্রিকেট তারকারাও এ শহরে যে পরিমাণ ভালবাসা পেয়েছেন তা ভারতের অন্য কোনও শহরে বোধহয় ভাবাই যায় না।
বর্ষীয়ান পাকিস্তানি ক্রিকেট সাংবাদিক আবদুর রশিদের তাই বলতে দ্বিধা নেই, পাকিস্তানের জন্য ভারতে এর চেয়ে ভাল মাঠ বোধহয় কিছু হতেই পারত না।
তিনি বলছিলেন, ‘এটা পাকিস্তানের জন্য খুব পয়া মাঠ। চার চারবার ভারতকে তারা ওয়ান-ডেতে এখানে হারিযেছে। হ্যাঁ, বিশ্বকাপে আমরা কখনও ওদের হারাইনি ঠিকই, কিন্তু কে বলতে পারে পয়া ইডেনেই আমাদের কপাল খুলে যাবে না? আর তা ছাড়া এ মাঠের মেজাজটাই আলাদা – দর্শক এখানে ক্রিকেটের সমঝদার, এ মাঠের একটা ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে।’
আবদুর রশিদ যেটাকে ক্রিকেটের জন্য ভালবাসা বলছেন, ইডেনের প্রধান প্রবেশপথের সামনে দুই প্রবীণ সিএবি সদস্য – যারা পঞ্চাশ বছর ধরে এ মাঠে খেলা দেখতে আসছেন – তারা আবার বাঙালির আবেগ বলেই এটাকে বর্ণনা করতে চান।
এম এন ভৌমিক ও পিএন ঘোষ নামে সিএবির ওই দুই ভেটারেন বলছিলেন, ‘টিকিটের জন্য এমন হুড়োহুড়ি তো কলকাতাতেই হবে – কারণ বাঙালি খেলা আর মেলা নিয়েই বুঁদ হয়ে আছে। আর পাকিস্তান ম্যাচ তো আলাদা জিনিস!’
বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে একটা কথা খুব বলা হয় – এই ম্যাচে জিতলে তারপর বিশ্বকাপ হারলেও কোনও দু:খ নেই। ম্যাচের একটা টিকিট যারা বগলদাবা করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে আজ প্রায় সেই বিশ্বজয়ের অনুভূতি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ক্রিকেট সাংবাদিক শমীক চক্রবর্তী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘সেই ১৯৮৭তে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল ইডেনে হবে কলকাতা সেই আশা করে বসেছিল। কিন্তু সে বার অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সে দুটো দলই সেমিফাইনালে হেরে যায় – আর তার প্রায় তিরিশ বছর পর আজ ইডেনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচে এ মাঠে মুখোমুখি হচ্ছে দুটো দেশ।’
মি চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তান দুটো দলেরই পরস্পরের প্রতি ভাল শ্রদ্ধা আছে – মাঠে অল্পস্বল্প ঝগড়াঝাঁটি হলেও দুদলই খেলার স্পিরিট বজায় রেখে চলবে বলেই তার বিশ্বাস – এবং উডেন শেষ পর্যন্ত একটা দারুণ ম্যাচ উপহার পাবে।
কোনও সন্দেহ নেই ইডেন গার্ডেন্স একটা অসম্ভব উপভোগ্য ম্যাচ দেখার জন্য মুখিয়ে আছে – কিন্তু মাঠের লড়াই শুরু হওয়ারও অনেক আগে কলকাতার আরও বড় লড়াই শুরু হয়ে গেছে – আর তা হল টিকিট জোগাড়ের লড়াই!