বিদ্যুৎ আমদানি করার ওপর আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি

0
361

সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। এ বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কী প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে— এমন এক প্রশ্নে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা রিজিওনাল পাওয়ার সেক্টরে একটি পরিবর্তন আনতে যাচ্ছি। আমরা মনে করি যত বেশি রিজিওনাল পাওয়ারের শেয়ারিং বৃদ্ধি করব ততই লাভবান হব। যদি ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাই তবে আমাদের খরচ হবে ১ বিলিয়ন ডলার। আর এজন্য আমাদের অবকাঠামোও তৈরি করতে হবে। কয়লা টার্মিনাল করতে হবে। কিন্তু যদি এই পরিমাণ বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করি তাহলে শুধু ট্রান্সমিটার লাইন ছাড়া আমাদের কিছুই করতে হবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের সমস্যা, সম্ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা বলেছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি রিজিওনাল পাওয়ার শেয়ারিংয়ে যদি দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করি তবে এটি হবে লাভজনক। এরই মধ্যে আমরা স্বল্পমেয়াদে ২৩ মার্চ ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করেছি। তেমনি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে যাচ্ছি। দীর্ঘমেয়াদে আমরা ভুটান থেকে আরও বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় এই যে, আমাদের দেশে যত বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করব তা ক্ষতি বয়ে আনবে। এর ফলে একদিকে যেমন জায়গা কমবে অন্যদিকে পরিবেশদূষণও বেশি হবে। সরকারি পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সংস্কার, পরিকল্পনা এবং নতুন কেন্দ্র তৈরি সম্পর্কে নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের একটি কনসালট্যান্ট গ্রুপ পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর (সরকারি) অডিটের কাজ করছে। আশা করছি এক মাসের মধ্যে আমরা এ বিষয়ে রিপোর্ট পাব। এরপর সেভাবে ব্যবস্থা নেব। যেসব পাওয়ার প্ল্যান্ট এখন চলছে সেখানে কী কী ধরনের পরিবর্তন করা দরকার। শুধু পাওয়ার জেনারেশনই নয়, পাওয়ার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও এ পরিবর্তন আনা হবে। আমরা আরেকটি কনসালট্যান্ট হায়ার করছি। গ্রিড আপগ্রেডেশন করার কাজ করছি। যেমন পহেলা নভেম্বরে যে ব্ল্যাক আউট হয়েছিল তার জন্য ‘গ্রিড ফেইলিউর’ দায়ী। এজন্য আগামীতে যাতে এটা না করে তার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। আমরা এলএলডিসিকে আধুনিক করার জন্য প্রকল্প নিয়েছি। বিদ্যুৎ বিভাগের সব ইউনিট ডিজিটালাইজড করার জন্য ইআরপি সিস্টেম শুরু করতে যাচ্ছি। বিদ্যুৎ খাতগুলোকে কীভাবে ভবিষ্যতের আর্থিক খাত হিসেবে স্বাবলম্বী করা যায় সেজন্য ফাইন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট হায়ার করতে যাচ্ছি। আমরা ভবিষ্যতে ‘পাওয়ার এনার্জি বন’ নামে মার্কেটে শেয়ার বা টাকা সোর্স করা যায় কিনা তা চিন্তা করছি। শিগগিরই বিবিয়ানা-৩, তিনটি লিকুইড ফুয়েল প্ল্যান্ট, বড়পুকুরিয়া, ১৩০০ মেগাওয়াট কয়লা, মাতারবাড়ী, পায়রা ও রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত কয়লা দেশের খনিগুলোতে আছে কিনা, সুন্দরবনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদীদের সমালোচনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি আমাদের মজুদকৃত কয়লাও উত্তোলন করি তবে এ কয়লা আগামী ৩০০ বছরে গিয়ে শেষ হবে। এখন আমরা যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করছি তার থেকে ১০ গুণ বেশি কয়লা উত্তোলন করলেও কোনো সমস্যা নেই। মূলত নতুন করে কয়লা খনি থেকে কয়লা তুলে আমরা কৃষকের জমি ও ধান উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে চাইছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও কৃষকের জমি নষ্ট করতে রাজি নন। তবে নতুন কয়লা খনি আবিষ্কারের জন্য যাচাই-বাছাই করা হবে। রামপাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) চুক্তি প্রক্রিয়া হতে যাচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও শুরু হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২১ সাল নাগাদ এর কাজ সম্পন্ন হবে। আমি মনে করি পরিবেশবাদীরা তাদের উদ্বেগ থেকেই সুন্দরবনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সমালোচনা করছেন। তবে যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজেই পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হয়। আমাদের দেখতে হবে এর প্রভাবে আমাদের বৃহত্তর কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা। এ নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। রামপাল নিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুন্দরবনে যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যাবে না প্রতিবেদনে এমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত সম্পর্কে নসরুল হামিদ বলেন, এ খাত থেকে আমাদের লক্ষ্য মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ উৎপাদন করা। পরে আরও ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ এ খাত থেকে উৎপাদন করার পরিকল্পনা আছে। হাইড্রো, সোলার ও বায়ু— এ তিন পদ্ধতিতে আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেছি। গ্রামে এখনো গ্রাহকদের লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করছি ২০১৯ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে পারব। বর্তমানে সঞ্চালন লাইনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ দিতে পারছি না। বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের পরও কেন কুইক রেন্টাল— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি মনে করি এখনো আমাদের কুইক রেন্টালের দরকার আছে। কারণ বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখনো উৎপাদনে আসেনি। এগুলোর উৎপাদনে আসতে ২০২১-২২ সাল লাগবে। সে সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। শিল্পে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা দারুণ হতাশ। ব্যাংক লোন নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী যন্ত্রপাতি কিনেছেন ঠিকই কিন্তু গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় কারখানা চালু করতে পারছেন না। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার আলোচনা করেছি। আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সেখানেই গ্যাস সংযোগ দিতে পারব যে এলাকাটি ইকোনমিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শিল্পে নতুন করে গ্যাস দেওয়া দুষ্কর। দেশের জ্বালানি খাতে বৈদেশিক ও বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা বেশ কিছু ইনভেস্টমেন্ট করার জন্য সুযোগ তৈরি করছি। যেমন রিলায়েন্স এলএনজিতে ৩০০০ মেগাওয়াট করতে চাচ্ছে। এ ছাড়া আদানি আমাদের কাছে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে চায়। চাইনিজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৫০ শতাংশ পার্টনারশিপে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে করতে যাচ্ছি। আরও যেসব অফার পেয়েছি তা যাচাই-বাছাই করছি। আমি মনে করি বিদ্যুৎ ছাড়া বাংলাদেশে আর অন্য কোনো খাতে এত বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। আমরা বর্তমানে ৫০০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ বেসরকারি খাত থেকে পাচ্ছি। আশা করছি আগামীতে আরও ৫০০০ মেগাওয়াট বেসরকারি খাত থেকে পাব। জ্বালানি খাতের দুর্নীতি রোধে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, সব কিছু ডিজিটালাইজড হয়ে গেলে দুর্নীতিও কমে আসবে। আমরা প্রি-পেইড মিটারব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছি। এর ফলে দুর্নীতি কমে আসবে। তবে ভালো একটি অবস্থানে পৌঁছাতে হলে আমাদের আরও তিন থেকে চার বছর লাগবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা নতুন করে ১০৮টি গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। ভোলা গ্যাসকূপ খনন হবে, গভীর ও অগভীর সমুদ্রেও কূপ খননের জন্য কথাবার্তা চলছে। আগামী ১৫ বছরে এ ক্ষেত্রে ভালো পরিস্থিতি তৈরি হবে। বিপিসি লোকসানে নেই, অথচ তেলের দাম কমানো হচ্ছে না— এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমিও মনে করি এখন তেলের দাম কমানোতে কোনো সমস্যা নেই। এজন্য ধীরে ধীরে তেলের দাম নির্ধারণের জন্য সমন্বয়ে যাওয়া উচিত। এজন্য আমাদের সিএনজি থেকে সরে তেলে ফিরে আসা উচিত বলে মনে করি। আমরা সিএনজির গ্যাস বিদ্যুতে নিয়ে আসতে চাই। জ্বালানি খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে নসরুল হামিদ বলেন, এ খাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জ্বালানি নিরাপত্তা। আমরা মিক্সড ফুয়েলে কত দ্রুততার সঙ্গে প্রতিটি জায়গায় নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি দিতে পারছি তা নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। আমরা জিএসবি ও মাল্টিপ্ল্যান সার্ভে করছি। এজন্য ভেসেল কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গ্যাস বিস্ফোরণের নানা ঘটনা ঘটছে। এর সমাধানে তিতাসের এমডিকে অব্যাহতি দিলেই কি হবে— এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিতাসের লাইনগুলো ৫০ বছরের পুরনো। নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষকে গ্যাস দেওয়া কঠিন। তিতাসের লাইনগুলোর বহু জায়গায় লিক হয়ে আছে। ভবিষ্যতে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন। তবে আমরা যত দ্রুত লিকুইডিফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে (আইপিজি) যেতে পারব, তত দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিত করতে পারব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here