খন্দকার তাজউদ্দিন:
আমাদের দেশে গামেন্টস পোশাক রপ্তানি করে বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসে। আর রেমিট্যান্স খাতে প্রবাসি শ্রমিকেরা পাঠায় প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অথাৎ বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে অর্জিত রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ।বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে এখন সবচেয়ে অস্থির সময় চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব বন্ধ বাজারগুলো নতুনভাবে খোলার চেষ্টা হলেও সফল হয়নি সরকার। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদি সহিংস যুদ্ধে রূপ নেয়া, নিজস্ব জনশক্তিকে কাজে লাগানো, কূটনৈতিক ব্যর্থতা সেই অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।যত দিন যাচ্ছে ক্রমশই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজার। অর্থনৈতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে অর্জিত আয় বা রেমিট্যান্স আজ হুমকির মুখে পড়ে গেছে। সরকারের ঐদাসিন্যে হঠাৎ করেই কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে দেশের শ্রমবাজার। নতুন শ্রমবাজার খোঁজার উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো সফলতার দেখা মেলেনি। এ অবস্থায় দেশের প্রায় ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক বাদে বাকিগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ও বৃহত্তম শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এ খাতে অশনি সংকেত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ। এসব প্রতিটি দেশে এক সময় বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। বর্তমানে ১৬০টি দেশে জনশক্তি রফতানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশসহ মাত্র ২০টি দেশে যে সংখ্যক কর্মী যায়, তার ২০ ভাগের এক ভাগও যাচ্ছে না বাকি ১৪০ দেশে। কিন্তু গত ৭ বছর ধরে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ, তিন বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ, সরকার পতনের আন্দোলন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে ইরাক ও লিবিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ, কুয়েতের শ্রমবাজারও প্রায় ৮ বছর বন্ধ। রোমানিয়া, গ্রিস, ইতালিসহ ইউরোপের কিছু দেশেও বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে এসব দেশও এখন আর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী জানান, বাংলাদেশের শ্রমবাজার যে নেই তা নয়। কিন্তু সে বাজার থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন কারণে দূরে সরে যাচ্ছে। সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে এমনটি হচ্ছে। সরকার বিদেশি শ্রমবাজার ধরে রাখতে সত্যিকার অর্থে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে বড় বড় শ্রমবাজার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
মালয়েশিয়াতে গত সাত বছরের বেশি সময় ধরে বৈধ ভাবে কোন কর্মী যেতে পারছে না। মাঝে সরকারের সঙ্গে ১৫ লাখ কর্মী নিয়োগের চুক্তি হয় কিন্তু পরে মালয়েশিয়ার সরকার তা বাতিল করে। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে কোন তথ্য দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিষয়টি ভেলকিবাজিতে পরিনত হয়েছে।
সৌদি আরবে ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত হয়, দেশটি ফের বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে। কিন্তু দেশটি শর্ত দেয় আগে ৫০ হাজার গৃহকর্মী পাঠাতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে মাত্র কয়েক হাজার গৃহকর্মী পাঠানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমান মহিলা কর্মী সৌদি আরব নিতে আগ্রহ দেখায় তা আমাদের দেশের পক্ষ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে পুরুষ কর্মী নেয়া থেকে বিরত রয়েছে দেশটি।
সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নেয়া বন্ধ করার পর বিকল্প বাজার হয়ে ওঠে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ২০১২ সালে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও গত তিন বছরে খোলেনি আমিরাতের শ্রমবাজার। বর্তমানে কিছু গৃহকর্মী ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ভিসা দিচ্ছে না আমিরাত সরকার। পরে ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ নির্বাচনে বাংলাদেশ দুবাইকে প্রথম দফায় ভোট না দেয়ায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়ে। বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি দেশটি। এ সময় দুবাইকে সমর্থন দিলে শ্রমবাজার খোলার বিষয়টি আরো সহজ হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ রাশিয়াকে সমর্থন দেয়। প্যারিসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি তিন দফা চলে এবং আমিরাত রাশিয়াকে পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড এক্সপোর ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত হয়। গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত সফরকালে শ্রমবাজারটি খুলবে বলে আশা করা হলেও তা হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্থানীয়দের চেয়ে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা নিরাপত্তা নিয়ে বেশ স্পর্শকাতর। এ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই আমিরাতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বাংলাদেশিদের অপরাধসংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আমিরাতের জেলখানায় বাংলাদেশি কয়েদির সংখ্যা সর্বোচ্চ। এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি খুন, ডাকাতি, চোরাকারবারী, জুয়া, মাদক ব্যবসা করার অভিযোগে সে দেশের কারাগারে আছে।
জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যেতে চায়। সেখানে গড়ে ৪ লাখের কিছু বেশি কর্মী বৈধ পথে পাঠানো সম্ভব হয়। অনেককে প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে নিয়ে যায় দালালরা। মালয়েশিয়ায় বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার সুযোগ আছে। ২০১৩ সালে জিটুজি পদ্ধতিতে নতুন করে কর্মী পাঠানোর চুক্তি হলেও তা ব্যর্থ হয়। এ পদ্ধতিতে গত দুই বছরে মাত্র ৮ হাজার কর্মী পাঠায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অথচ দেশটিতে ১৫ লাখ কর্মীর চাহিদা রয়েছে।
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন বাংলাদেশি কর্মী বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজারগুলো বন্ধ হওয়ার পর জনশক্তি রপ্তানির হারও কমে গেছে। ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৪ জন, ২০১০ সালে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জন, ২০১১ সালে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন, ২০১২ সালে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন এবং ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ৩ লাখ ৮২ হাজার ২৯৮ জন কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছে। ২০১৫ সালে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৬৬৭ জন কর্মী বিদেশে চাকরি পেয়েছেন। এখন ২০১৬ সালের টার্গেট ৭ লাখের বেশি কর্মী বিদেশ পাঠানো। শ্রমবাজার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, জনশক্তির বাজার বাড়াতে নতুন করে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। কর্মীদের বিদেশি ভাষায় পারদর্শিতা, প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক অ্যাক্রেডিটেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন করা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদার আলোকে বিদ্যমান কোর্স কারিকুলামকে নিয়মিত আপগ্রেড করা, বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত প্রশিক্ষণের মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখার জন্য নিয়মিতভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়েছে মন্ত্রণালয়। কর্মীরা দক্ষতা অর্জন করলে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকেই কর্মী নেবে। তখন আর আমাদের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বেগ পেতে হবে না।