পাকিস্তানের চিত্রলে ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী কালাশের বাস। তারা কথা বলে নিজস্ব ভাষায়, উদযাপন করে নিজস্ব সংস্কৃতি। গান, নাচ ও মদ্যপানের মধ্য দিয়ে উপাসনা করে ঈশ্বরের।
কালাশ গোষ্ঠীদের অবাধ যৌনতা, নাচের মধ্য দিয়ে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং যে কোন সময় নারীদের তার নতুন মনের মানুষের কাছে চলে যেতে পারার এ সংস্কৃতি ঠিক যেন পাকিস্তানের চলমান ধারার একেবারেই উল্টো এক ধারা। যেন এক পাকিস্তানের ভেতর আরেক পাকিস্তান।
তবে ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠী বর্তমানে খুবই আতংকে দিন পার করছে। তরুণ সম্প্রদায় ব্যাপক হারে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে বলে তাদের আশংকা এ সংস্কৃতি বেশিদিন টিকে থাকবে না।
কালাশ গোষ্ঠী ২০০৮ সাল থেকে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেইজে তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে আসলেও এখনো সফল হতে পারেনি। এজন্য তারা আমলাতন্ত্রকে দায়ী করছে।
কালাশ সম্প্রদায়ের লোকজনের ত্বক ফর্সা, চোখের রঙ হালকা। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, তারা কোন এক সময় প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা ছিলেন। অথবা তারা হয়তো আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর সেনা বাহিনী থেকে এসেছে। আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্বাব্দ চতুর্থ শতকে এই এলাকা দখল করেছিলেন।
কয়েক শতাব্দী আগে কালাশ গোষ্ঠী চিত্রল এলাকা শাসন করলেও বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজারে। কালাশ পিপলস ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (কেপিডিএন) এ কথা জানিয়ে বলেছে, তাদের ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে।
স্কুলে কালাশ শিশুরা ইসলাম সম্পর্কে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে কোন শিক্ষা পাচ্ছে না। এছাড়া তাদেরকে মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও বিরূপ আচরণের শিকার হতে হচ্ছে। এসব কারণে কালাশ গোষ্ঠীতে দিন দিনই ধর্মান্তরিত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
কেপিডিএন-এর অ্যাকটিভিস্ট লিও রেহমাত বলেন, কালাশ একটি চলমান সভ্যতা। পাকিস্তান সরকারের উচিত একে রক্ষা করা। তিনি ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত না হওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করেন।
ইসলামাবাদে ইউনেস্কোর সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা জাওয়াদ আজিজ বলেন, কালাশদের যে চমৎকার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, তা ইউনেস্কোর তালিকাভুক্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কালাশদের সংস্কৃতির চমকপ্রদ একটি বিষয় ‘বাসালি’। প্রত্যেক গ্রামে এক রকম একটি বাসালি রয়েছে। যেখানে ঋতুমতী নারী তার রজঃকালীন সময়ে এই ঘরে অবস্থান করে। এসময় তাকে অপবিত্র বিবেচনা করা হয় এবং সে কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই আলাদা করে তাকে বাসালিতে রাখা হয়। এই ঘরে বসেই সে বইপড়া কিংবা সেলাইয়ের কাজ করে। ঘরের দরজায় তাকে খাবার এনে দিয়ে যাওয়া হয়।
এছাড়া কারও মৃত্যুতে শোক পালন করে না কালাশ গোষ্ঠী। বরং মৃত্যুকে তারা জীবনপ্রবাহের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করে । এসময় তারা নাচ, গান ও ভোজ উৎসবের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে উদযাপিত করে।
বিয়ের সংস্কৃতিও কালাশদের ভিন্নরকম। বরের বাবা মায়ের বাড়িরে সামনে নাচ গানের মধ্যদিয়ে বিয়ের বিষয়ে উভয়ে সম্মত হয়। পরে কনের বাবার বাড়িতে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। কালাশ সংস্কৃতিতে স্বামীকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ের অধিকার নারীর রয়েছে। তবে তার নতুন প্রেমিককে অবশ্যই কনে নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
আজিজ জানান, ইউনেস্কো, সরকার ও কালাশ সম্প্রদায়ের মধ্যে ২০১২ সালে সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পরে আর আনুষ্ঠানিক কোন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।
চিত্রলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কালাশের নিজস্বতা রক্ষায় সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
চিত্রলের জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা ওসামা আহমদ অরাইজ বলেন, ‘এখানে নিয়োগ নিয়ে আসার পর কালাশ সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষায় আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’