মিল্টন বিশ্বাস
১৪২৩ বঙ্গাব্দ শুরু হলো। একটি বছর খুব দ্রুতই শেষ হয়। কারণ বছরজুড়ে পৃথিবীতে এতো ঘটনা ঘটতে থাকে যে মানুষের পক্ষে সময়ের হিসাব-নিকেশ করে জীবন সাজানো কঠিন হয়ে ওঠে। আর কেবল পৃথিবী কেন এখন বিশ্বব্রহ্মা- খুব কাছের আমাদের। এজন্য অজানা বিশ্বলোকের ঘটনাও মানব জীবনকে প্রভাবান্বিত করে। তবু নতুন বছর নতুন প্রত্যাশায় জেগে উঠে। জীবন নতুন সময়ের বৃত্তে আবর্তিত হয়। ১৪২৩ বঙ্গাব্দের সময়বৃত্তে শুভ কিছু অপেক্ষা করছে- এই স্বপ্নে মানুষ বড় বেশি আন্দোলিত হতে চায়। কিন্তু ভাল কিছু নির্মাণ করতে মানুষকেই নিরন্তর চেষ্টা করতে হয়। কিছু মানুষের কর্মপ্রচেষ্টায় এগিয়ে চলে পৃথিবী। সেই মানুষই আমাদের আদর্শ। ভাল মানুষ, আদর্শ মানুষ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাবে এই প্রত্যাশা নিয়ে বৈশাখ দিয়ে নতুন বছরের পথ চলা শুরু হলো। কিন্তু বাস্তবতা আরো বেশি নিষ্ঠুর। আমাদের মতো বেশি মানুষের দেশে সর্বত্র হয়রানি ও নাজেহাল হওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশ জীবনকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে তবু সাধারণ মানুষের চলার পথ খুব সহজ-সরল নয়। একদিকে জঙ্গিবাদী তৎপরতা অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতা মানুষকে হরহামেশায় বিপন্ন করে। তবে চৈত্র মাসের তীব্র তাপদাহে দগ্ধ জীবন পেরিয়ে নতুন বছর বিপন্ন ও বিষণœতা মুক্ত হবে এই প্রত্যাশা আমাদের।
নতুন বছরের সূচনা মুহূর্তে আমাদের প্রত্যাশা বৈশাখ থেকে জঙ্গিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা দেখতে চাই দেশের মানুষ নিরাপদে যার যার ধর্ম পালন করছে; বাঙালির আবহমান উৎসবসমূহ নির্বিঘেœ উদ্যাপিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের আয় বৃদ্ধি করে সচ্ছলতা এনেছে নিজ পরিবারে। দেখতে চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা পাচ্ছে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। নতুন বছরে এসব আশা আর আকাক্সক্ষায় দুলে উঠুক আমাদের জীবন। কিন্তু জঙ্গিগোষ্ঠীর নানা অপতৎপরতার ইতিহাসও আমাদের মনে রাখতে হবে। গেল বছর(১৪২২) জুড়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামে তাদের নাশকতার প্রস্তুতি ও ধ্বংসাত্মক কাজের সন্ধান পাওয়া গেছে। র্যাব ও পুলিশের অভিযানে অনেকে ধরাও পড়েছে। এই অভিযান কেবল নয় বিচার ও শাস্তি হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেখতে হবে জঙ্গি সদস্যরা নির্মূল হচ্ছে কিনা। আবার কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয় সামাজিকভাবে তাদের প্রতিরোধ করাও জরুরি। একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকা- বৃদ্ধি করে তরুণ সমাজকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হবে। যেমন তরুণ সমাজ জেগেছিল ১৪২০ বঙ্গাব্দে। সে সময় তরুণ সমাজ নিজেরাই জেগে উঠেছে। তরুণরা নিজেরাই ঠিক করেছে কী করতে হবে। একাত্তরেও এমনটি হয়েছিল। কাউকে বলে দিতে হয়নি। একাত্তরে তরুণরাই দেশ স্বাধীন করেছিল। ’৫২ সালেও বলে দিতে হয়নি তাদের কী করতে হবে। তারা আমাদের রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে, কলঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো ন্যায়বিচার। আর ফাঁসি ছাড়া সব তরুণ রাজপথ আকড়ে ছিল। আর সেদিনের সেই প্রতিবাদ সমাবেশের পর বিচারিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ও কার্যকর হয়েছে।
মূলত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কারাদ-ের রায় প্রত্যাখ্যান করে যারা সেই ১৪২০-এর পহেলা বৈশাখের আগে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হয়েছিল তারা কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্মের কর্মী নন। তারা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান; যে মধ্যবিত্ত অনেকের কাছে সুবিধাবাদী শ্রেণি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেদিন ছাত্র-ব্লগারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ‘শাহবাগ স্কয়ার’। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানানো হয়। শাহবাগের সেই আহবান ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বিভিন্ন ব্যানারে খ- খ- মিছিলে ভরে যায় সমগ্র দেশ। শহীদ মিনারের খোলা ময়দান পরিণত হয় প্রতিবাদ চত্বরে। সে সময় ‘জেগেছে মানুষ, ফুঁসছে দেশ। প্রাণে প্রাণে আজ একাত্তরের মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস’ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। উজ্জীবিত অগণিত হাত আর গগণবিদারী সেøাগানে উচ্চারিত হয়েছে একটাই দাবিÑ ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই’। তপ্ত রোদের মধ্যে বসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জাগরণের গান গেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা বর্তমান তরুণ সমাজের অন্যতম পাথেয়।
তরুণ সমাজের প্রত্যাশা ১৪২২ বঙ্গাব্দে পূর্ণতা পেয়েছে তিনজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া যে গতিশীল হয়ে উঠেছে তা সকলের কাছে স্পষ্ট। সংশয় এবং সন্দেহ দূর হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর আস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সারা বিশ্বের মিডিয়া উৎসুক হয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ আধুনিক ও সভ্য জাতির মর্যাদায় আসীন হতে পারবে। বাঙালি হিসেবে গ্লানি মুক্তির দিন শীঘ্রই আমাদের সামনে উপস্থিত হবে বলে বিশ্বের মানবতাবাদী কর্মীদেরও প্রত্যাশা। একইসঙ্গে বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছে এই বিচার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য জামাত-শিবিরের নাশকতার তা-ব। ছাত্র-শিবির ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা একত্রিত হয়েছে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করে বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য। এতোদিন যাদের নেতা ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আদেশ পালন করে মানুষ হত্যা করেছে; বোমা-গ্রেনেড মেরে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে; সেই কর্মীরা জানত না কত বড় অপরাধীদের পিছনে তারা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করছে। তাদের সেইসব তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম নেতারা ফাঁসিতে ঝুলছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সারা বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে। অপরাধগুলো ভয়াবহ। জামাতি নেতারা কখনো বাংলাদেশ চায়নি; তাই মুক্তিযুদ্ধের পরও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এইসব সাদা-দাড়ি-টুপির অপরাধী মানুষগুলো পাকিস্তান ও ইসলামের নামে বাঙালি জাতিকে চিরতরে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল; তারা ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকা-ে সহযোগিতা, প্ররোচনা এবং অনেকক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে একাত্তরের নয় মাস আমাদের পবিত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। আমাদের অকুতোভয় মুক্তিসেনাদের দৃঢ়তায় তাদের সব প্রচেষ্টাই ভেস্তে যায়। দেশ স্বাধীন হয়। আর দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে সামরিক শাসকদের সমর্থনে তার সুফল ভোগ করেছে একাত্তরের অপরাধীরাও। তাদের সন্তানরা নিজেকে শিক্ষিত করার সুযোগ পেয়েছ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছে, তাদের সমর্থকরা স্বাধীন দেশে বিচরণ করছে। কেউ কেউ নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের মতে, এ পরিস্থিতিতে ১৪২৩ বঙ্গাব্দে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের সুস্থ ধারায় আসতে হবে; দায়িত্ব নিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বোঝানোর। হরতাল, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতা ত্যাগ করতে হবে। কারণ এসব কর্মী-সমর্থকরা গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীর কবল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে; এখন নিজেকে গড়ে তুলতে হবে সোনার বাংলা ও জয় বাংলার প্রতিধ্বনির মধ্যে দিয়ে। শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি তাদের পাথেয় হবে। কারণ তাদের নেতাদের পিছনের ইতিহাস ভয়ঙ্কর।
১৪২৩ বঙ্গাব্দে আমরা যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। এজন্য দরকার বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রগতিশীল উদ্দীপনা। রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে তরুণদের সন্ত্রাস প্রতিরোধের আন্দোলনকে জোরদার করে তুলতে হবে। কারণ সরকারি দলের ওপর আস্থা থাকলেও স্বাধীনতা-বিরোধীরা এখনো সক্রিয়। যত দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হচ্ছে, তত দিন গণদাবিতে সোচ্চার থাকা দরকার। আর যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক জামায়াত-শিবির-বিএনপিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাদের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাটিতে এই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের স্থান হবে না। তাদের শেকড় যতো গভীরে থাকুক তরুণ সমাজ তা উৎপাটন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে কঠোর শাস্তি চাই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর। তাদের বিচার প্রক্রিয়াও দ্রুত সম্পন্ন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে এখন তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। বাংলা নববর্ষে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com)