বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের বেশির ভাগই উদ্ধার হয়নি। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি। তদন্তে অগ্রগতি বলতে চুরির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দেশের ২০ নাগরিককে শনাক্ত করার দাবি করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির দুটি টিম ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় তদন্ত করে তাদের শনাক্ত করে। চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত আট কর্মকর্তাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাঁদের ব্যক্তিগত ই-মেইল আদান-প্রদান, মোবাইল ফোনের কথোপকথন ও ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তাঁদের কারো নাম জানাতে রাজি হননি তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। অর্থ চুরির সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কম্পিউটার থেকে ম্যালওয়ারের মাধ্যমে মিসরে তথ্য পাঠানোর চেষ্টা চালানো হয়েছিল সেটি নিয়ে চলছে বিস্তর অনুসন্ধান। এ-সংক্রান্ত তদন্তে মিসরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছে সিআইডি। স্পর্শকাতর এ ঘটনার তদন্তে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এফবিআইয়ের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, তদন্তে ইতিমধ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। জড়িতদের তালিকা আগের চেয়ে ছোট হয়ে আসছে। তবে কার্যত এই তদন্তের অগ্রগতি নির্ভর করছে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা ও মিসরের গোয়েন্দাদের সহযোগিতার ওপর। দীর্ঘ তদন্তে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কম্পিউটার থেকে ম্যালওয়ারের মাধ্যমে তথ্য পাঠানোর চেষ্টা ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শত শত কম্পিউটারের মধ্যে এখন পর্যন্ত এই একটি কম্পিউটার ঘিরে তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা। মূলত ওই কম্পিউটারটি ঘিরে তাঁরা কিছুটা আশার আলো দেখছেন। তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। শাহ আলম বলেন, ‘ওই কম্পিউটার থেকে পাওয়া তথ্যের সত্যতা জানতে আমরা মিসরের গোয়েন্দা সংস্থার দিকে তাকিয়ে আছি। নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের গোয়েন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সার্বিক তদন্তে ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের এবং অ্যান্টি মানি লন্ডারিং গ্রুপের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহভাজন দেশি-বিদেশি অপরাধী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, মিসরের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কী ধরনের তথ্য পাওয়া যায়, সেটাই তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেখান থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে অনেক রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। সেই সঙ্গে এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মী জড়িত রয়েছেন কি না তাও জানা যেতে পারে। রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা যাওয়া সিআইডির দুই টিম দেশে ফিরেছে। টিমের সদস্যদের সঙ্গে গতকাল সোমবার বিকেলে সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে জানান, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দেশের কমপক্ষে ২০ নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে। সিআইডির দুটি টিম ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় তদন্ত করে তাদের শনাক্ত করে। তাদের আইনের আওতায় আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে। সিআইডি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তারও দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে। এরও তদন্ত চলছে। সব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। সংবাদ সম্মেলনে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত বিদেশিদের নামও জানানো হয়। তাঁরা হলেন ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখার ম্যানেজার মায়া সান্তোস দেগুইতো, এঞ্জেলা রুথ তোরেস, মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভেরগারা, এনরিকো টিয়োডরো ভ্যাসকুয়েজ, উইলিয়াম সো গো, ক্যাম সিং অং ওরফে কিম অং, রোমালদো আগ্রাদোর, শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের শালিকা পেরেরা, মিয়ুরিন রানা সিংহে, প্রদীপ রোহিথা, সান্থা নালাকা ওয়ালাকুলুয়ারাচ্চি, সঞ্জিভা তিসা বান্দারা, শিরানি ধাম্মিকা ফার্নান্দো প্রমুখ। সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাকে অর্থপাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। চক্রের সদস্যরা হয়তো ধারণা করেছে, ফিলিপাইনের আইন তাদের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক। ফিলিপাইনের যে প্রতিষ্ঠানটির অবহেলার কারণে অর্থপাচার হয়েছে তারা কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। রিজাল ব্যাংকের ওই শাখায় মাত্র ৫০০ ডলার জমা দিয়ে যে চারটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে সেখানে মাত্র একটি লেনদেন হওয়ার পর আট কোটি ১০ লাখ ডলার জমা হলো, কোনো তদন্ত ছাড়াই তারা সেই টাকা কিভাবে ছাড় করল? তাদের উচিত ছিল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বারবার জানতে চাওয়া। এই টাকা যদি সন্ত্রাসী অর্থায়নে চলে যেত তাহলে ব্যাংক কি দায় এড়াতে পারত? বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে কি না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের সংশ্লিষ্টার বিষয়ে লিংকগুলো খোঁজা হচ্ছে। এটার জন্য আরো কিছুদিন সময় লাগবে। শাহ আলম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, ‘তাঁরা প্রযুক্তি বোঝেন না, তাই হয়ে গেছে। কিন্তু প্রযুক্তি বুঝি না এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখানে সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যার কারণে এখানকার কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ দায়িত্বে গাফিলতি করেছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি।’ টাকা ফেরত পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু টাকা ফেরত পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে। মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী অর্থপাচারের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বিগুণ টাকা দিতে বাধ্য থাকবে। তদন্তদলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আব্দুলাহিল বাকী বলেন, তাঁদের একটি টিম গত ৬ থেকে ১৪ এপ্রিল ফিলিপাইনে ও ৬ থেকে ১৫ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় ছিল। সেখানে তারা বিপুল পরিমাণ তথ্য পেয়েছে। সেগুলো এখনো সামারাইজ করা হয়নি। সিআইডি সূত্রে জানা যায়, তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৫০টি কম্পিউটার জব্দ করা হয়। এসবের মধ্যে ৫০টি কম্পিউটার আলাদা করে প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে তার থেকে সন্দেহজনক ৩২টি কম্পিউটার ঘিরে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে এর মধ্যে একটি কম্পিউটার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। ওই কম্পিউটার থেকেই রিজার্ভের অর্থ চুরির সময় ম্যালওয়ারের মাধ্যমে মিসরে তথ্য পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নিয়ে যায় হ্যাকাররা। এ ঘটনায় গত ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলা হয়। ওই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই টাকা চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তদন্ত করছে সিআইডি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিস, ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্ট ও সিকিউরিটি সার্ভেইল্যান্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি শাখার ৫০টি কম্পিউটার টার্গেট করে তদন্ত শুরু করেন সিআইডির কর্মকর্তারা। ওই সব কম্পিউটারের ফরেনসিক ইমেজ নিয়ে তা সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সংযুক্ত কম্পিউটারে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছিল। এসব কম্পিউটার থেকে পরিশোধ আদেশ দিয়ে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ চুরি করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সিআইডি সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সন্দেহভাজনরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো কাজেই আপাতত দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না। পাশাপাশি প্রায় ৩০০ সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। রিজার্ভের হিসাব পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়েছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। তবে এর মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমানের যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অফিস আদেশে বলা হয়, ‘এক্সিকিউটিভ ফোরাম ফর পলিসি মেকারস হাই অফিশিয়াল’ সংক্রান্ত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে তিনি ১৮ ও ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করবেন। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ তিন শাখার কম্পিউটারের মাধ্যমেই হ্যাকাররা টাকা চুরি করেছে। হ্যাকারদের এই কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কেউ সহযোগিতা করেছে। এ কারণে যে কম্পিউটারটি হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে তা চিহ্নিত করার পর তথ্য যাচাই-বাছাই করে কর্মকর্তারা দেখতে পেয়েছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাত-আটজন কর্মকর্তা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। তাঁদের ই-মেইল আদান-প্রদান, মোবাইল ফোনের কথোপকথন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত এগিয়ে চলেছে। যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে প্রায় দুই কোটি ডলার ফেরত এসেছে। ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী কিম অং কিছু টাকা ফেরত দিয়েছেন। বাকি টাকা উদ্ধারের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।’ জানা যায়, তদন্তে এফবিআই প্রযুক্তিবিষয়ক ফরেনসিক ইস্যু, হ্যাকিং হওয়া সুনির্দিষ্ট কম্পিউটার ও আইপি অ্যাড্রেস চিহ্নিত করে সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের কমিটিও কাজ করে যাচ্ছে।