বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত নয়!

0
256

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের হিসাব থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮৩৫ কোটি টাকার সমান ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত নন বলে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ স্থানান্তরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্দেশনা দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটলমেন্ট সিস্টেম (আরটিজিএস)’-এর দুর্বলতার কারণে হ্যাকিং সম্ভব হয়েছে। এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে তাঁদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার তথ্য মিলেছে। আর চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের পাশাপাশি গোপনে অপরাধী শনাক্ত করার চেষ্টা করছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। অপরাধী শনাক্ত করার পর মামলা দায়ের করে সরকারকে জানানোর পরিকল্পনা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও তাঁর অধীনদের। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সচিবালয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন। প্রতিবেদনটিতে রিজার্ভ চুরি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর থাকলেও প্রতিবেদন গ্রহণকালে অর্থমন্ত্রী কিংবা তদন্ত কমিটির কেউ সাংবাদিকদের এ-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেননি। তদন্ত কমিটি গঠনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া হ্যাকিং সম্ভব নয়। ব্যর্থতার অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই) দেয় সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিং রুমের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলেও তাঁদের অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট। এ অবস্থার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদনে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না থাকার তথ্য জানাল তদন্ত কমিটি। তবে কমিটি এ-ও বলেছে যে ৪ ফেব্রুয়ারি  হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েছে ৬ তারিখে। ৪ তারিখে জানার পর দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ফিলিপাইনে যাওয়া অর্থ ঠেকানো সম্ভব ছিল। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে মন্ত্রীর দপ্তর থেকে বের হওয়ার সময় ড. ফরাসউদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত কি না? বা রিপোর্টটি প্রকাশ করা হবে কি না? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। রিপোর্টটি পড়ার পর হয় সরকার কথা বলবে, নতুবা আমাদের বলবে কথা বলার জন্য।’ অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনটি প্রণয়নের আগে তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. ফজলে কবির ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গেও বিস্তারিত আলোচনা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছে কমিটি। রিজার্ভ চুরির মতো স্পর্শকাতর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার এক মাস পর পর্যন্ত সরকারের কাছে বিষয়টি গোপন রাখার কারণ সম্পর্কে তদন্ত কমিটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান জানিয়েছেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আগে আইটি নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা চলছিল। সে কারণেই বিষয়টি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অপরাধী চিহ্নিত করে মামলা দায়ের করার পরই সরকারকে জানানোর পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের নিরাপত্তা সফটওয়্যার অকার্যকর ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা ঊর্ধ্বতনদের জানায়নি। দুর্বল আইটি ব্যবস্থার কারণেই হ্যাকিং সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরটিজিএসের দুর্বলতার কারণে হ্যাকারদের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সার্ভারে ঢুকে অবৈধ পেমেন্ট আদেশ পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সুইফট সার্ভারের সঙ্গে আরটিজিএস সংযুক্ত করার ফলেই এই দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। অর্থ স্থানান্তরের আদেশ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে তা নিষ্পত্তি পর্যন্ত আরটিজিএস ব্যবহার হয়ে থাকে।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরটিজিএস অনলাইনে তাৎক্ষণিক অর্থ লেনদেন-প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় নির্দেশনা পাঠানোর একটি সমন্বিত পদ্ধতি হিসেবে কাজ করছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এক লাখ টাকা বা তার বেশি স্থানীয় মুদ্রার তাৎক্ষণিক স্থানান্তর এবং সরকারি সিকিউরিটিজ ও বিদেশি মুদ্রাভিত্তিক লেনদেন নিষ্পত্তি করা যায়। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে আরটিজিএস কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। আরটিজিএস বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সলিউশন প্রদান করেছে সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সিএমএ স্মল সিস্টেমস এবি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য শক্তিশালী আইটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা একটি বিভাগ স্থাপনের সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি সফটওয়্যারের ব্যবহার বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। তাই দেশি সফটওয়্যার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে দেশি আইটি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে এই বিভাগ পরিচালনার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া এই বিভাগে কর্মরতদের সব সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়ে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, তদন্ত বিষয়ে আর কোনো কিছু বলবেন না তিনি। পরে রাত ৮টার দিকে সচিবালয় থেকে বাসায় ফেরার সময় তিনি বলেন, ‘আমি এখনো রিপোর্টটি পড়িনি। না দেখে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়।’ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, রিপোর্টে কী আছে, তা সরকার বলবে। আদৌ রিপোর্টটি প্রকাশ করা হবে কি না, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। রিপোর্টটি সরকার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুক, এ জন্য সরকারকে দম নেওয়ার সময় দিতে হবে, হজম করার জন্য সময় দিতে হবে এবং সরকারকে একটু সময় দেওয়াটা খুব ফেয়ার (উচিত) হবে।’ তিনি বলেন, সরকার বলেছে, বিষয়টি তারা আগে পরীক্ষা করবে, তারপর এ বিষয়ে আপনাদের (মিডিয়া) সঙ্গে কথা বলবে। ‘তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট’-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট না হলে কোনো কাজে হাত দিই না। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ড. ফজলে কবির, তদন্ত কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও সদস্যসচিব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস উপস্থিত ছিলেন। কমিটি গঠনের ৭৫ দিনের মাথায়—অর্থাৎ ৪৫ দিন পর চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন তাঁরা। তবে গতকাল বিকেলে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কমিটির আজকেই রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। তাঁরা রিপোর্ট দিক। আমি আগে দেখি, পরে কথা বলব।’ এদিকে রাত ৮টার দিকে সচিবালয় থেকে বাসায় যাওয়ার পথে প্রতিবেদনে কী আছে, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আগে পড়ে দেখি। না পড়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ওই টাস্কফোর্সের প্রথম বৈঠক হবে। সেখানে ড. ফরাসউদ্দিনের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গত ১৫ মার্চ ড. ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারির চার দিন পর ২০ মার্চ ফরাসউদ্দিন হেয়ার রোডের বাসভবনে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের ভার গ্রহণ করেন। কার্যপরিধি অনুযায়ী, সেদিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল কমিটির।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here