আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এক পার্বত্য গুহার ওপর ২১ হাজার ৬০০ পাউন্ড ওজনের এক বিশাল বোমা ফাটিয়েছে। হোয়াইট হাউসের দাবি, জিবিইউ-৪৩ নামে পরিচিত এই বোমা ‘সব বোমার মা’।
শক্তির দিক দিয়ে প্রায় পারমাণবিক বোমার সঙ্গে তুলনীয় এই বোমার আকার এত বড় যে আকাশ থেকে তা ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে বিশেষ সামরিক বিমান ব্যবহার করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত, অর্থাৎ অপারমাণবিক বোমার মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ ধরনের মোট ১৫টি বোমা তাদের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে, যার প্রতিটির দাম ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এদিকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ‘বোমার মা’ ফেলার এক দিন পর মস্কো বলেছে, তাদের ভান্ডারে যে বোমা আছে, তা ‘সব বোমার বাবা’। গত শুক্রবার মস্কো টাইমসের খবরে বলা হয়, মার্কিন ‘মা বোমার’ চেয়ে রুশ ‘বাবা বোমার’ শক্তি ও ওজন—দুটোই বেশি। রাশিয়ান মেকানিকস নামের বিজ্ঞান পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে মস্কো টাইমস জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ‘মা বোমার’ ওজন ১০ টনের কিছু কম। পক্ষান্তরে রাশিয়ার ‘বাবা বোমার’ ওজন ৪৪ টন। তবে উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে দুই বোমার মধ্যে কোনো তফাত নেই—উভয় বোমাই বিস্তৃত এলাকা ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী তাদের বোমাটি আইএসের পাহাড়ি গোপন সুড়ঙ্গপথ ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করেছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন কী জরুরি প্রয়োজন পড়ল যে সিরিয়ায় ৫৯টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে বিশাল ওই বোমা ফেলতে হলো? অনেক সামরিক বিশ্লেষকই মনে করছেন, সামরিক অর্থে ‘বোমার মা’ তেমন বড় কৌশলগত কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুসারে, সিরিয়া ও ইরাক থেকে পালিয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে—এমন আইএস জঙ্গির সংখ্যা ৮০০ বা তার চেয়েও কম। আফগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জিবিইউ-৪৩ বোমার আঘাতে অন্তত ৯০ জন আইএস জঙ্গি নিহত এবং তাদের গোটা কয়েক সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস হয়েছে। এই সীমিত সামরিক লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল ধ্বংসক্ষমতার ওই বোমা ফেলেনি বলেই মনে করছেন অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ। ইউএস টুডে পত্রিকা একাধিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছে, আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতি নামমাত্র, তাদের সামরিক শক্তিও সীমিত। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের প্রধান শত্রু তালেবান। খবরে বলা হয়, ট্রাম্পের বিশাল এই বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখ্য কারণ হতে পারে, দেশের ভেতরে সমালোচকদের বোঝানো যে সিরিয়ায় বোমা ফেলার অর্থ এই নয় যে তিনি (ট্রাম্প) আইএস থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছেন।রাশিয়ার ‘সব বোমার বাবা’
ইউএস টুডের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সদ্য বুঝতে শুরু করেছেন, তাঁর হাতের নাগালে কী অভাবিত সামরিক ক্ষমতা রয়েছে। তিনি চকচকে জিনিস ভালোবাসেন, সে জন্য প্রথমে টমাহক মিসাইল পাঠালেন, তারপর এই ‘বাবা বোমা’।
পরপর এই দুই হামলার অন্য সম্ভাব্য কারণ, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়াকে বার্তা দেওয়া। উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে, তারা খুব শিগগির নতুন পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে। তা গতকাল শনিবারই হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। উত্তর কোরিয়া বলেছে, পারমাণবিক বোমা দিয়ে হামলা করা হলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়েই সাড়া দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক অস্ত্রের উচ্চাভিলাষ ঠেকাতে তাঁর দেশ একাই সামরিক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর এরই মধ্যে কোরীয় উপদ্বীপের দিকে যাত্রা করেছে। এনবিসি টেলিভিশন জানিয়েছে, এই নৌবহরের একটি ডেস্ট্রয়ার উত্তর কোরিয়ার আণবিক পরীক্ষার স্থল থেকে ৩০০ মাইল দূরে অবস্থান নিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুয়ামেও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলো তৈরি রয়েছে বলে জানা গেছে। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ বাধাতে নয়, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক পরীক্ষা থেকে নিবৃত্ত করতে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
জিবিইউ-৪৩ বোমা ফাটানোর অন্য কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে রাশিয়াকে বার্তা দেওয়া যে, নরম ভাষায় কথা বলার দিন শেষ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যাপারে ট্রাম্প নমনীয় এই সন্দেহ থেকে অনেকেই মস্কোর সঙ্গে তাঁর ‘গোপন আঁতাতের’ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রথমে মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র সিরিয়ায় বোমা হামলা, তারপর আফগানিস্তানে ‘বোমার মাকে’ ফাটানোর মাধ্যমে ট্রাম্প আসলে বোঝাতে চাইছেন, মস্কোর সঙ্গে তাঁর আঁতাতের জল্পনার কোনো ভিত্তি নেই।
তবে রাশিয়াকে ভীত করার লক্ষ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্র ১০ টনের বোমাটি ফেলে থাকে, তাহলে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। নিজেদের অস্ত্রভান্ডারে আরও বড় ও শক্তিশালী বোমা রয়েছে জানিয়ে মস্কো পাল্টা বার্তাও দিয়ে দিয়েছে। ৪০ টনের ওই ‘সব বোমার বাবার’ খবরটি দিতে গিয়ে মস্কো টাইমস শিরোনাম করেছে, ‘প্রিয় আমেরিকা, রাশিয়া তোমাকে জানাতে চায়, তার কাছে তোমার চেয়েও বড় বোমা রয়েছে।’