লিয়াকত হোসেন খান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বৈচিত্র্যময় তিতাস নদী বিধৌত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে ভারত উপমহাদেশে এ জেলার পরিচিতি রয়েছে। বাংলার সেন-বংশের রাজত্বকালে এই এলাকায় কোনো অভিজাত ব্রাহ্মণ-পরিবার ছিল না। ফলে পূজা-পার্বনে হিন্দুদের খুবই অসুবিধা হতো। তাই রাজা লক্ষ্মণ সেন ‘কন্য কুঞ্জ’ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ-পরিবার এখানে এনেছিলেন। সেই ব্রাহ্মণদের আস্তানা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উত্তরে হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে কুমিল্লা জেলা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলা। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সড়কপথে দূরত্ব ১০২ কিলোমিটার। রেলপথে দূরত্ব ১২৬ কিলোমিটার। বিখ্যাত সংগীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ,ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, কবি অজয় ভট্টাচার্যের জন্ম এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই জেলাঅয় আছে আরফাইল মসজিদ ও জোড়া কবর (সরাইল), কালীভৈরব মন্দির, শ্রীশ্রী আনন্দময়ী আশ্রম, সীতাদাহ মন্দির, উলকাপাড়া মসজিদ, হরষপুর জমিদারবাড়ি, নবাব স্যার শামসুল হুদার বাড়ি, ভাদুঘর শাহী মসজিদ।
প্রকৃতির আদেরের দুলালী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সুজলা-সুফলা শস্যা-শ্যামলা। তিতাস নদীর তীরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অপরূপ নিসর্গশোভিত। এখানের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সোনালি ফসল ফলে। সারাবছরই থাকে সবুজে সবুজে আচ্ছন্ন। বছরের যে কোনো সময় আপনি বেড়িয়ে আসতে পারেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাবেন মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে। রাত যাপনে একানে আধুনিক আবাসিক হোটেল রয়েছে।
বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রধানত সরাইল, দাউদপুর, নূরনগর ও বলদাখাল পরগনাগুলো নিয়ে গঠিত ছিল। এগুরোর মধ্যে বলদাখাল পরগনা ছিল সর্ববৃহৎ। মোঘল আমরে এই পরগনার নাম ছিল বলদাখাল এবং ব্রিটিশ আমলেও সেই নামই বহুকাল ধরে প্রচলিত থাকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির পীঠস্থানরূপ সুপরিচিত। এর পেছনে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গৌরবময় ঐতিহ্য। এখানে তিতাস নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। তিতাসের তীরে বালু চিকচিক করে। তিতাস নদীর তীরে বেড়ানো যায়। এর দুই কূলে দেখবেন সবুজ-শ্যামল রূপ। গ্রাম আর গ্রাম। যেদিকে তাকাবেন চোখ যেন খুঁজে পাবে সবুজের আদিগন্ত সাগর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পূর্বদিকে গেলে ‘চম্পকনগর’ নামে একটি পাহাড়ি এলাকা দেখতে পাবেন। এখানে মাটির রং লাল। চম্পকনগর বেড়াতে গিয়ে দেখবেন প্রাচীনযুগের পাতলা ইটের তৈরি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ। এসব তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধযুগেওর আগে। এগুলো হিন্দু রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলেও অনেকে মনে করেন।
চম্পকনগর দেখে এবার আখাউড়া রেলওয়ে জংশেনের কাছাকাছি দেবগ্রামে চলে যান। এখানের মাটিও লাল। দেবগ্রামে একদা বৌদ্ধসভ্যতার কেন্দ্র ছিল।
কসবায় গেলে দেখবেন হোসেন শাহ’র নির্মিত কৈলারগড় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। হোসেন শাহ আগরতলা রাজ্য আক্রমণের সময় এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। দুর্গের চারপাশ ঘুরে দেখুন।
এবার পুরা রাজার জাঙ্গাল দেখতে চলে যান। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নূরনগর ও বলদাখাল পরগনার উপর দিয়ে মেঘনানদীর পূর্বতীরে এসে শেষ হয়েছে। এটি পাঠান সম্রাট শেরশাহের আমলে নির্মিত হয়।
মুসলিম সমৃদ্ধিতে সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকা। সরাইলে আছে বেশ কয়েকটি মসজিদ। এর অধিকাংশগুলো নির্মিত হয় মোগল আমলে। মোঘলী প্যাটার্নে নির্মিত মসজিদটি দেখে পুরোনো ইতিহাস খুঁজে পাবেন। এ মসজিদটিকে সরাইল মসজিদ বলা হয়। এটি ১৬৭০ সালে তৈরি হয়েছিল। তখন সরাইলের দেওয়ান ছিলেন নূর মোহাম্মদ। তাঁর স্ত্রী আরফান্নেসা এই সুন্দর মসজিদটি তৈরি করিয়েছিলেন। মসজিদে ৫টি দরজা দেখবেন। গোলাকার মিনার, সুন্দর মেহরাব মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মসজিদ চূড়ায় আছে সুন্দর একটি ছোট গম্বুজ। মসজিদের যেদিকে তাকাবেন দেখবেন সর্বত্রই যেন ঝলমল করছে।
সরাইল বাজারের প্রায় ২ মাইল পশ্চিমে গেলে দুটি প্রাচীন দীঘি দেখবেন। এর একটি নাম ‘সাগর দীঘি’।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে উলচাপাড়া গ্রামে গেলে একটি মসজিদ দেখবেন। বিলাঞ্চল আছে এখানে। বিলের আশপাশ বিচিত্র ধরনের পাখি দেখবেন। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভাদুঘর গ্রামের মসজিদটি ঘুরে দেখুন। এটি মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে জমিদার বন্দাহ শাহবাজ ইবনে মজলিশ কর্তৃক নির্মিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরো দেখবেন বিভিন্ন স্থাপত্য কীর্তি, যেমন – শিবমূর্তি, কালভৈরব মন্দির, বিষ্ণুমূর্তি।
নাসিরনগর জায়গাটি বহু ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাসিরনগর নাম হয়েছে হযরত নাসিরউদ্দিন চেরাগ। দেহলভীর নামানুসারে। তিনি ছিলেন হযরত শাহ জালাল (রহ.)-এর একজন সঙ্গী। নাসিরনগরে দেখবেন বিলাঞ্চল। পাশেই মেঘনা নদী। নদীতে নৌবিহার করতে পারেন।
সরাইল উপজেলার শহরতলিতে একটি কালীমন্দির রয়েছে। এটিও দেখে নিন। কালোপাথরে নির্মিত এক ফুট দীর্ঘ কালীমূর্তিটি সাধু অচিন্ত্যরাম কর্তৃক নির্মিত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কয়েকদিন বেড়িয়ে প্রবল আনন্দ পাবেন। কিন্তু এখানকার ছানামুখী যদি না খান তাহলে আপনার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখানের মিষ্টি ও ছানামুখী আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ছানামুখীর সুখ্যাতির মূলে যাঁর অবদান বেশি তিনি হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মহাদেব ঠাকুর। তাঁর নামানুসারেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টির কেন্দ্রস্থলটির নাম রাখা হয়েছে মহেদেবপট্টি। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। ১৮৫৩ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন এবং মিষ্টির দোকান খোলেন।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওার জন্য রেলপথে ট্রেন অভা সড়কপথের পরিবহনকে বেছে নিন। কমলাপুর ও সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে বিআরটিসি’র বাস। সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। তিতাস কমিউটার, মহানগর গোধূলি আন্তঃনগর ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া যায়। তিতাস কমিউটার প্রতিদিন তিনবার কমলাপুর থেকে ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যায়।
যেখানে থাকবেনণ : রাত যাপন করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে- হোটেল রওশন, হোটেল, সাগর, হোটেল শান্তা নীড়, গোলাপ গেস্ট হাউস, লাকি রেস্ট হাউজ, আঁখি রেস্ট হাউস, তিতাস রেস্ট হাউস, বাংলাদেশ রেস্ট হাউস, হোটেল রাব্বি, হোটেল আনসারি, হোটেল স্টার, সিটি রেস্ট হাউস, হোটেল মিডনাইট, আমজাদিয়া বোর্ডিং প্রভৃতি।
অন্যান্য তথ্য : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস, সালদা, মেঘনা নদী। উপজেলা ৮টি। এগুলো হলো- বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর, আশুগঞ্জ, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া, কবসা আর নাসিরনগর। এ জেলার আয়তন ১,৯২৭ বর্গকিলোমিটার। দেশের বৃহত্তম তিতাস গ্যাস এখানেই। আশুগঞ্জ জিয়া সার কারখানা ও আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ দেখার মতো।